নিজামুদ্দিন আউলিয়া

সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহী, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ - ৩ এপ্রিল ১৩২৫) (উর্দু: حضرت شیخ خواجہ سیّد محمد نظام الدّین اولیاء), হযরত নিজামুদ্দিন নামেও পরিচিত, হলেন ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সূফি সাধক। ভারতে চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মহান সূফি সাধকদের মধ্যে তিনি একজন।[1] তার মূল ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকার, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী হয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির সাথে মিলিত হয়। এই অনুযায়ী তারা চিশতিয়া তরিকা মৌলিক আধ্যাত্বিক ধারাবহিকতা বা সিলসিলা তৈরী করেছেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, তার পূর্বসূরীদের ন্যায়, প্রেম বা ইশককে স্রষ্টা বা আল্লাহ প্রাপ্তির পন্থা বা পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা মানবতার প্রতি ভালবাসার জন্ম দেয়। জিয়াউদ্দির বারানি নামে চৌদ্দ শতকের একজন ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, দিল্লির মুসলমানদের উপর তার প্রভাব এমন ছিল যে পার্থিব ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্বিকতা এবং ইবাদতের প্রতি মনোযোগী এবং দুনিয়াবী চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। [2]

হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া
ধর্মইসলাম, চিশতিয়া তরিকা
ব্যক্তিগত
জন্ম১২৩৮
বাদায়ুন (বর্তমানঃ উত্তর প্রদেশ)
মৃত্যু৩ এপ্রিল ১৩২৫
দিল্লী
জ্যেষ্ঠ পোস্টিং
ভিত্তিকদিল্লী
খেতাব(محبوبِ الٰہی) (سُلطان المشائخ) সুলতাল-উল -মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহি,
অফিসে কার্যকাল
তের শতাব্দির শেষের দিকে এবং চৌদ্দ শতাব্দির শুরর দিকে
পূর্বসূরীফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার
উত্তরসূরীনাসির উদ্দিন চিরাগ দেহলভী, আমির খসরু, আখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ, বোরহান উদ্দিন গরিব প্রমুখ

জীবন

নিজামুদ্দিন আউলিয়া উত্তর প্রদেশের (দিল্লীর পূর্বে) বাদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। পাচঁ বছর বয়সে তার পিতা, আহমদ বাদায়ুনি, মৃত্যুর পর তিনি তার মায়ের (বিবি জুলেখা) সাথে দিল্লীতে চলে আসেন।[3] ষোলতম শতাব্দিতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল মোবারক রচিত আইন-ই-আকবর এ নিজামুদ্দিনের জীবনী উল্লেখ রয়েছে। [4] বিশ বছর বয়সে, নিজামুদ্দিন পাকিস্তানের আজোধানে (বর্তমানে পাকপাত্তান) এ যান এবং সূফি সাধক ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকারের, বাবা ফরিদ নামে অধিক খ্যাত, শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বাবা ফরিদ বর্তমান থাকা অবস্থায় তিনি প্রতি বছর রমজান মাস অতিবাহিত করতে আজোধানে যেতেন। আজোধানে তৃতীয় বার যখন গিয়েছিলেন, বাবা ফরিদ তাকে নিজের খলিফা হিসেবে মনোনিত করেছিলেন। এর কিছু দিন পর, যখন নিজামুদ্দিন দিল্লিতে ফিরে আসেন, তিনি বাবা ফরিদের পরলোক গমনের খবর শুনেন।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার চিল্লা, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার বাসস্থান, হুমায়ুন এর সমাধির উত্তর-পুর্ব দিকে, দিল্লি

গিয়াসপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার আগে, নিজামুদ্দিন দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতেন। তিনি সেখানে তার খানকা, একটি আধ্যাত্বিক স্থান যেখানে সর্বস্তরের মানুষের সেবা করা হয় এবং তিনি সেখানে অন্যদের আধ্যাত্বিক শিক্ষা প্রদান করতেন, প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তার নিজস্ব আবসস্থল ছিল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই খানকাটি গরিব-ধনীসহ সকল প্রকারের মানুষের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তার অনেক শিষ্য আধ্যাত্বিকতার উচ্চ আসন অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে শেখ নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ চিরাগ-এ-দিল্লি,[5] এবং প্রখ্যাত সূফি/গায়ক এবং দিল্লি সালতানাতের রাজ্যসভার কবি আমির খসরু[4] তিনি এপ্রিল ৩, ১৩২৫ সালে সকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মাজার, নিজামুদ্দিনের দরগাহ দিল্লিতে অবস্থিত।[6] এবং বর্তমানে স্থাপনাটি ১৫৬২ সালে নির্মিত হয়।

সাজরাগত ইতিহাস

পীরগত বংশানুক্রম বা সাজরা

  1. হযরত মুহাম্মদ (সঃ)
  2. হযরত মওলা আলী ইবনে আবু তালিব
  3. হযরত সৈয়দ হোসাইন ইবনে আলী
  4. হযরত সৈয়দ জয়নুল আবেদিন ইবনে হোসাইন
  5. হযরত ইমাম সৈয়দ মুহাম্মদ আল বাকির
  6. হযরত ইমাম সৈয়দ জাফর আল সাদেক
  7. হযরত ইমাম সৈয়দ মুসা কাজেম
  8. হযরত সৈয়দ আলী আল রিদা
  9. হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ আল তকি
  10. হযরত সৈয়দ আলী আল নকি
  11. হযরত সৈয়দ জাফর বুখারী
  12. হযরত সৈয়দ আলী আজগর বুখারী
  13. হযরত সৈয়দ আবি আব্দুল্লাহ বুখারী
  14. হযরত সৈয়দ আহমদ বুখারী
  15. হযরত সৈয়দ আলী বুখারী
  16. হযরত সৈয়দ হোসাইন বুখারী
  17. হযরত সৈয়দ আব্দুল্লাহ বুখারী
  18. হযরত সৈয়দ আলী (ডেনিয়েল হিসেবে পরিচিত)
  19. হযরত সৈয়দ আহমদ বাদায়ুনি
  20. হযরত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন আউলিয়া

আধ্যাত্বিকতার ইতিহাস

মুগল রাজকুমারী জাহানারা বেগমের সমাধি (বামে), নিজামুদ্দিনের মাজার(ডানে) এবংজামা’য়াত খানা মসজিদ কমপ্লেক্স, নিজামউদ্দিন দরগাহ কমপ্লেক্স, পশ্চিম নিজামুদ্দিন, দিল্লি।

নিজামুদ্দিন যখন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের নাম প্রথমবারের মত শুনেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র বার কি তের বছর এবং তখন থেকেই ফরিদউদ্দিনের প্রতি তার হৃদয়ে সম্মান ও ভালবাসার জন্মাতে থাকে। তিনি তার শিষ্যগণকে বর্ণনা করেন, বাবা ফরিদ এর নাম শুনার পর তার মনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কোন সূফি সাধকের নাম শুনে এমনকি তাদের সাথে সাক্ষাতের পরও তার এ অবস্থা হয়নি। আগুনের ফুল্কির মত তার প্রেম বাড়তেই থাকে। যদি তার সহপাঠীরা তারঁ দিয়ে কোন কাজ করাতে চেষ্টা করত তখন তারা বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিত এবং তিনি কখনও কেউ বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিলে সে কাজে মানা করতেন না। তিনি তার জীবনে কারো জন্য এ ধরনের অনুভুতি অনুভব করেননি। বিশ বছর বয়সে পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি বাবা ফরিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার জীবিত জীবনে তিনি বাবা ফরিদের দরবারে তিনবার গিয়েছিলেন।

আধ্যাত্বিক বংশানুক্রম বা সাজরা

  1. মুহাম্মদ
  2. হযরত মওলা আলী ইবনে আবু তালিব
  3. হাসান -আল-বসরী
  4. আব্দুল ওয়াহিদ বির জিয়াদ
  5. ফুধাইল বিন ইয়াধ
  6. ইব্রাহিম বিন আদম
  7. হুজাইফাহ আল-মার’আশি
  8. আবু হুবাইরাহ বসরী
  9. মুমশাদ দিনাওয়ারী

চিশতিয়া তরিকার শুরু:

  1. আবু ইশক শামি
  2. আবু আহমদ আবদাল
  3. আবু মুহাম্মদ বিন আবি আহমদ
  4. আবু ইউসুফ বিন সামান
  5. মাউদুদ চিশতি
  6. শরীফ জানদানি
  7. উসমান হারুনি
  8. মঈনুদ্দিন চিশতি
  9. কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী
  10. ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার
  11. নিজামুদ্দিন আউলিয়া

শিষ্যগণ

তার প্রায় ৬০০ এর বেশি খলিফা (খলিফা হচ্ছে একজন শিষ্য যাকে বায়াত গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হয় এবং স্বীয় মুর্শিদ বা পীরের বংশানুক্রমকে বিস্তার করার দায়িত্ব দেয়া হয়) আছে যারা বিশ্বময় তার আধ্যাত্বিক সাজরাকে বজায় রেখেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত শিষ্যগণ হল:

নাসিরুদ্দির চিরাগ দেহলভী

আমির খসরু

তিনি ছিলেন তার পীর বা মূর্শিদের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। তিনি তার মূর্শিদের এতটিই প্রিয় ছিলেন যে একদা নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেন, "যদি শরিয়ত আমাকে অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সাথে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম।" তিনি আরো বলেন, কেউ যদি আমার রওজা (সমাধিস্থল) জিয়ারত করতে আসে; তাহলে সে যেন প্রথমে আমির খসরুর রওজা আগে জিয়ারত করে তারপর তার রওজা। পীরের পরলোক গমনের কয়েক মাস পর তিনিও পরলোক গমন করেন। তাকে তার পীরের পায়ের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। তার মাজার দিল্লী নয়াদিল্লীরনিজামুদ্দিন দরগাহে

আখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ

বোরহানুদ্দিন গরীব

জালালুদ্দিন ভান্ডারী

সৈয়দ মাহমুদ কাশকিনাকার

আযান ফকির

==অমীয় বাণী== ক্বালবের ওযু না হলে মানুষ পবিত্র হয় না।

পরিবার

উপাধি

১. মেহবুব-এ-ইলাহি (ইলাহ বা আল্লাহর ভালবাসার পাত্র)।

২. সুলতান-উল-মাশায়েখ (মাশায়েখদের রাজা)।

৩. ইমাম -উল-মেহবুবিন (মেহবুবিনদের নেতা)।

৪.মালিক-উল-ফুকরা ওয়াল মাসাকীন।

৫. তাজ-উল-মুকাররবীন।

৬. মেহফিল-এ-সুখান (মেহফিলের আকর্ষণ)।

৭.জারি’জার বকশ (সোনা ও রুপা বিতরণকারী) ।

৮. নিজামুদ্দিন বা’হাত

৯. মেহফিল-এ-শিখার।

১০. তাবিব-ই-দিল

১১. গাউন-উল-আলম (পৃথিবীর গাউস)

১২. জাগ উজিয়ারে (পৃথিবীর আলো)

ওরশ

প্রতি বছর রবি সানি ১৭ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ওরশ (মৃত্যুবার্ষিকী) নিজামুদ্দিন দরগাহে পালিত হয় এবং শাওয়াল ১৮ তারিখে আমির খসরুর ওরশও পালিত হয়।

জনপ্রিয় মাধ্যমে

  • আরজিয়া নামে একটি একটি কাউয়ালী সঙ্গীত যেটির সুর করেছেন এ আর রহমান এবং যেটি ২০০৯ এ মুক্তি পাওয়া দিল্লি ৬ এ ব্যবহার করা হয়, সেটি নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে উৎসর্গ করা হয়।
  • কুন ফায়া কুন, ২০১১ সালে মুক্তি প্রাপ্ত চলচিত্র রকস্টার এ ব্যবহৃত একটি গান যা নিজামুদ্দিন দরগাহে চিত্রায়িত করা হয় এবং তাঁকে উৎসর্গ করা হয়।
  • "নিজামউদ্দিন আউলিয়া" নামে বাংলায় একটি জনপ্রিয় সুফি সংগীত আছে যা তার দিল্লীতে ঐতিহাসিক পুনর্গামনকে তুলে ধরে।

আরো পড়ুন

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Bhakti poetry in medieval India By Neeti M. Sadarangani. Pg 60
  2. Schimmel, Annemarie (১৯৭৫)। Mystical Dimensions of Islam। Chapel Hill: University of North Carolina Press। পৃষ্ঠা 348। আইএসবিএন 0-8078-1271-4।
  3. name=khus>nizamuddin-auliya-dargah.html Nizamuddin Auliya
  4. Nizamuddin Auliya ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৭ জুলাই ২০১১ তারিখে Ain-i-Akbari, by Abu'l-Fazl ibn Mubarak.English tr. by Heinrich Blochmann and Colonel Henry Sullivan Jarrett, 1873–1907. The Asiatic Society of Bengal, Calcutta, Volume III, Saints of India. (Awliyá-i-Hind), page 365."
  5. http://timesofindia.indiatimes.com/Opinion/Editorial/In_The_Name_Of_Faith/rssarticleshow/msid-1922531,curpg-2.cms In The Name Of Faith] Times of India, 19 April 2007.
  6. "Nizamuddin Auliya Dargah, history and structures"। ৯ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ এপ্রিল ২০১৫

বহিঃ সংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.